আইপিএলের “এল ক্লাসিকোয়” ও চেন্নাই সুপার কিংসের ধোনি ধামাকায় অবশেষে ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়ামে জয়ের হাসি হাসলো চেন্নাই সুপার কিংস

অঙ্কিতা দাস : রবিবারের আইপিএল ম্যাচটিকে “এল ক্লাসিকো” ম্যাচ বলা হয় আর এই ম্যাচেই মুম্বাইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে রীতিমতো জয়ের দামামা বাজিয়ে গেল চেন্নাই সুপার কিংস বিশেষত চেন্নাই সুপার কিংসের মহেন্দ্র সিং ধোনির বিধ্বংসী ঝড়ো ধামাকা।
ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়ামে মহেন্দ্র সিং ধোনির বিধ্বংসী ব্যাটিং ঝড়ে ঢাকা পড়ে গেল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের রোহিত শর্মার দুর্ধর্ষ শতরানও; এই স্টেডিয়ামেই মহেন্দ্র সিং ধোনির হাত ধরেই বিশ্বকাপ জয় হয়েছিল ভারতের আর সেই জয়টাও এসেছিল মহেন্দ্র সিং ধোনির খেলা ৬ রানের বিনিময়েই। আজ আবারো এই স্টেডিয়াম সাক্ষী রইল ২২ গজের যুদ্ধে ৬ এর হ্যাটট্রিক খেলা এই মহান খেলোয়াড় মহেন্দ্র সিং ধোনির অসাধারণ খেলার। বয়সকে হারিয়েও নিজের দক্ষতা ও পারফরম্যান্সের মধ্যে দিয়ে আজও সকলের মন জয় করে নিলেন সকলের প্রিয় মহেন্দ্র সিং ধোনি; ধোনি ঝড়ে রোহিত শর্মার শতরানও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সকে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারল না। অবশেষে মহেন্দ্র সিং ধোনির বিধ্বংসী ব্যাটিং ঝড়ের মধ্য দিয়েই চেন্নাই সুপার কিংসের রান সংখ্যা দাঁড়ায় ২০৬ রান ৪ উইকেটের বিনিময়ে; যার মোক্ষম জবাব দিতে গিয়েই মাত্র ১৮৬ রান ৬ উইকেটের বিনিময়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যায় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স। যার দরুন ২০ রানের বিনিময়ে আজকের “এল ক্লাসিকো” ম্যাচটি জিতে যায় চেন্নাই সুপার কিংস।
ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়াম যদিও মুম্বাইয়ের তবুও মহেন্দ্র সিং ধোনির ক্ষেত্রে কোনো মাঠ বা কোনো স্টেডিয়ামই একান্ত সেই দলের হয়ে থাকে না; আজকের খেলার মঞ্চেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি। তাইতো, রবিবারের ম্যাচে ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়াম গ্যালারি নীল জার্সির পাশাপাশি হলুদ জার্সিতেও ভরে রইলো আর সেই সাথেই উল্লাসে জয়ধ্বনিতে স্বাগত হলো চেন্নাই সুপার কিংসের। কিন্তু সবার প্রতীক্ষার অবসান ঘটলো ১৯.২ ওভারে, কারণ এই শেষ ওভারেই ২২ গজের যুদ্ধে পা রাখল সকলের প্রিয় মহেন্দ্র সিং ধোনি।
অবশেষে মাহেন্দ্রক্ষণ এলো ১৯.২ ওভারে হার্দিক পান্ড্যের বলে ড্যারিল মিচেলের বাউন্ডারি ধরা পড়াতে আর তাতেই উত্তাল হয়ে ওঠে ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়াম; সেটা মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের সাফল্যের জন্য নয় বরং মহেন্দ্র সিং ধোনির স্টেডিয়ামে খেলতে আসার জন্য।
রবিবারের গ্যালারি উত্তাল হয়ে উঠলেও মহেন্দ্র সিং ধোনি ছিলেন শান্ত ও নির্লিপ্ত এবং তিনি শান্তভাবেই ক্রিজে খেলার জন্য স্ট্যান্ড পজিশন নিয়ে নেয়; অপরদিকে, তাঁর প্রতিপক্ষ হার্দিক পান্ড্যেও তৈরি হয়ে নেয় ২২ গজের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার জন্য। কিন্তু হার্দিক পান্ড্যের করা পরবর্তী ৩টি বলে মহেন্দ্র সিং ধোনি যে এইভাবে জবাব দিবেন, তা দর্শকবৃন্দ সমেত ক্রিকেটপ্রেমী এমনকি তাঁর দলের সদস্যদেরও বিন্দুমাত্র কল্পনা ছিল না। তিনি হার্দিক পান্ড্যের ৩টি বলেই পরপর ৩টি ৬ মেরে হ্যাটট্রিক করেন এবং সেই সাথেই নিজের দল চেন্নাই সুপার কিংসকে জয়ের মঞ্চে তুলে ধরেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির এই ৬ এর হ্যাটট্রিক গুলো ছিল যথাক্রমে, হাফ ভলি, মিড উইকেট ও এল ফুলটস; হার্দিক পান্ড্যের চতুর্থ বলটিও যদি ঠিকমতো মহেন্দ্র সিং ধোনির ব্যাটে লাগত তাহলে সেই বলেও তিনি ছক্কাই হাঁকাতেন। আজকের ম্যাচে মহেন্দ্র সিং ধোনি একাই চেন্নাই সুপার কিংসকে ২০০ রানের সীমারেখা পার করিয়ে দিলেন এবং নিজেও ৪ বলে ২০ রানে অপরাজিত রইলেন।
ধোনি ঝড়ের পূর্বেই চেন্নাই সুপার কিংসের ভিত মোটামুটি শক্ত করে দিয়েছিলেন চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড় এবং দক্ষ ব্যাটসম্যান শিবম দুবে; অধিনায়ক ঋতুরাজের পূর্বে কেন অজিঙ্ক রাহানেকে ওপেনিং করতে দেওয়া হল না তা জানা না থাকলেও রাচিন রবীন্দ্রর সঙ্গে অজিঙ্ক রাহানের জুটি যে সঠিক হয়নি তা অবশ্যই বোঝা গিয়েছিল সেই ইনিংসে। খেলা শুরুর দিকে এই জুটি কিছুই করতে পারেনি শুধুমাত্র অতিরিক্ত বল খেলা ছাড়া; তবে রাহানের শিবিরে ফিরে যাওয়ার পর অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড় ক্রিজে নেমে নিজের ভঙ্গিতে খেলা চালিয়ে যেতে শুরু করেন। অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড়ের ব্যাটিংয়ের সামনে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের কোনো বোলারই খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারেনি।
তবে ঋতুরাজের বিপরীতে রাচিন রবীন্দ্র তাঁর সাথে সঙ্গত দিতে পারেননি; তাইতো রাচিন রবীন্দ্র শিবিরে ফিরে যাওয়ার পরই চেন্নাই সুপার কিংসের রান রেট ও রান সংখ্যা দুটোই পুনরায় বেড়ে যায়। রবীন্দ্রর পরে ঋতুরাজের সাথে জুটি বাঁধতে আসে দক্ষ ব্যাটসম্যান শিবম দুবে; ওয়াংখেড়ের স্টেডিয়াম তাঁর পূর্ব পরিচিত থাকায় তিনি অতি সহজেই পিচের ভালো মন্দ বিচার করেই দ্রুত রান নিতে শুরু করেন। সেই জন্যই তো ৩ উইকেটের পর চেন্নাই সুপার কিংসের রান সংখ্যা বেড়ে হল ৯০ রান; চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড় শিবিরে ফিরে গেলেও শিবম দুবের বিধ্বংসী ঝড় তখনও বিন্দুমাত্র কমেনি। তাইতো অতি সহজেই অর্ধশতরান করেছিলেন শিবম দুবে; কিন্তু আজকের ম্যাচ জয়ের আনন্দ, গ্যালারির উল্লাস সবটাই যেন ছিল শুধুমাত্র মহেন্দ্র সিং ধোনির জন্য।
চেন্নাই সুপার কিংসের ২০৬ রানের রান সংখ্যা পাহাড় সমভাবে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের দিকে এগিয়ে দিলে, তারা সেটা পার করে জয়ের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবে কিনা তার অনেকাংশই নির্ভর করছিল মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক রোহিত শর্মা ও ওপেনার ব্যাটসম্যান ঈশান কিশানের ওপর। ম্যাচের শুরুটা ভালোই করেছিলেন এই জুটি; প্রথম ২ ওভার এই জুটির কেউই খেলতে পারেনি, অবশ্য তৃতীয় ওভারে এই জুটি খেলেওছেন আবার দলকে ৪০ রানের উপহারও দিয়েছেন। তৃতীয় ওভারের পরবর্তীতে রবীন্দ্র জাদেজা মাঠে খেলতে আসলে দলের রান রেট কিছুটা কমলেও তা ১০ রানের নিচে নামে না। এই একটা ওভারে যেন সব পুরো খেলাটাই ঘুরে যায় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের; অষ্টম ওভারে মাথিশা পাথিরানাকে খেলার সুযোগ করে দেয় চেন্নাই সুপার কিংসের অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড় আর সেই ওভারের প্রথম বলেই শ্রীলঙ্কার এই বোলার মাথিশা পাথিরানা অসাধারণভাবে উইকেট নিয়ে নেয় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের দক্ষ ওপেনার ব্যাটসম্যান ঈশান কিশনের।
খানিকটা মরিয়া হয়েই মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স তিন নম্বরে খেলতে নামায় সূর্যকুমার যাদবকে; কিন্তু বিধি বাম হওয়াতে মাত্র দুটো বলের বেশি ক্রিজে টিকতে পারলেন না সূর্যকুমার যাদব। অবশেষে চেন্নাই সুপার কিংসের দক্ষ বোলার মাথিশা পাথিরানার বলেই ক্যাচ আউট হন তিনি আর তাঁর এই ক্যাচটি নির্দ্বিধায় আইপিএলের সেরা ক্যাচ হিসেবে গণ্য হতে পারে। পাথিরানার করা এই বলটি তুলে দিয়েছিলেন থার্ডম্যানের দিকে আর বলটি আরেকটু হলেই ছক্কা হয়েই যাচ্ছিল; কিন্তু অসাধারণভাবে মুস্তাফিজুর রহমান সেই ক্যাচটি লুফে নেয় অথচ তাঁর ভারসাম্য বিগড়ে যাওয়ার দরুন তিনি প্রথমে বলটি ওপর দিকে ছুঁড়ে ফেলেন, পরবর্তীতে নিজের ভারসাম্য সামলে নিয়ে বাউন্ডারি ক্রস করে মাঠের ভেতরে এসে পুনরায় লুফে নেন সেই ক্যাচটি। এই অসাধারণ ক্যাচটিকে পুনরায় রিভিউতে দেখার পরেই আউট দেওয়া হয় সূর্যকুমার যাদবকে।
কিছু সময়ের ব্যবধানে পরপর দুটি উইকেট হারিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স; এমতাবস্থায় থেকে দলের হাল শক্তভাবে ধরার চেষ্টা করে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক রোহিত শর্মা এবং দক্ষ খেলোয়াড় তিলক বর্মা। এই দুই খেলোয়াড়ই আগ্রাসী মনোভাব নিয়েই খেলছিলেন এবং এদের এইভাবে খেলাতেই মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের দলের রান সংখ্যায় যোগ হয় ৬০ রান। কিন্তু পুনরায় আবারো অধিনায়ক ঋতুরাজ গায়কোয়াড় মাঠে খেলতে নামায় শ্রীলঙ্কার বেস্ট বোলার মাথিশা পাথিরানাকে আর এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারে না মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ব্যাটসম্যান। তাইতো, পাথিরানার দ্বিতীয় ইনিংসের প্রথম বলেই উইকেট হারায় মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের তিলক বর্মা আর যার দরুন মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের জয়ের আশাও ধীরে ধীরে নিভে যেতে থাকে। অপরদিকে, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সে নিজের স্থানকে ৫ নম্বরে নিয়ে আসেন হার্দিক পান্ড্যে; তিনিও শেষ চেষ্টা করেন তাঁর দলকে জেতানোর, কিন্তু তা আর সম্ভবপর হয়ে ওঠে না চেন্নাই সুপার কিংসের অসাধারণ পারফরম্যান্সের কারণে। তবে বর্তমানে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের অধিনায়ক হার্দিক পান্ড্যের খেলার ফর্ম এতটাই খারাপ যাচ্ছে যে, তিনি সমালোচনার থেকে এড়িয়েও বাঁচতে পারছেন না; অবশেষে কোনোমতে চারটি বল খেলে পঞ্চম বলে ছয়ের আশায় খেলতে গিয়েই ক্যাচ আউট হয় তিনি। তাঁর ক্যাচটি ধরেন তাও আবার তুষার দেশপান্ডে, যাকে কিনা এর পূর্ববর্তী ম্যাচগুলোতেও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স খুব ভালোভাবেই নাস্তানাবুদ করেছিল।
ইনিংসের শেষের দিকে মুস্তাফিজুর রহমানের বলে দুটি ৬ মেরে ডেভিড মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সকে জয়ের হাল্কা একটা আশা দেখালেও তা আর বাস্তবে রূপায়িত হয় না; অতি আত্মবিশ্বাস ও আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে খেলতে গিয়েই কিছু সময়ের ব্যবধানে বাউন্ডারির ধারেই ক্যাচ আউট হন তিনি। মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের আজকের ম্যাচে অসাধারণ পারফরম্যান্স দেখিয়েছেন, প্রাক্তন অধিনায়ক রোহিত শর্মা; একমাত্র তিনিই খেলার শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থেকে শতরান করেছিলেন, কিন্তু তাঁর এই শতরান মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের মুখে জয়ের হাসি ফোটাতে পারলো না পূর্ববর্তী ব্যাটসম্যানদের স্ট্রাইক রেট কম থাকায়।
নববর্ষের এই শুভক্ষণে মহেন্দ্র সিং ধোনি পুনরায় বুঝিয়ে দিলেন যে, বয়স শুধুমাত্রই নিছক একটা অঙ্ক তা কখনো দক্ষতার বিচার করতে পারে না।