কার সিনেমায় অভিনয়ের ডাক পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলেন অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী ?

0

বেবি চক্রবর্তীঃ পেট চালাতে সার্কাস দলে কাজ করতেন অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী, সাজতেন জোকার—-! না গল্প নয়, সত্যি, এটাই বাস্তব। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালিতে প্রসন্ন গুরুমশাই-এর চরিত্র করার সময়ই সত্যজিৎ রায়ের নজরে পড়েন তিনি। পরে সত্যজিৎ রায় যখন তাকে মুখ্য চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন “পরশ পাথর” এ, সেই সময় হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলেন আনন্দে। শুটিং এর সময় লোকেশন-এ তার জন্য গাড়ী পাঠিয়ে দিতেন সত্যজিৎ রায়। দুদিন যাতায়াতের পর তিনি সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন- এই ট্যাক্সি করে যাতায়াত করতে তিনি পারছেন না। এতে তিনি তাঁর অভিনয়ের স্বত:স্ফূর্ততা হারিয়ে ফেলছেন। তারপর থেকে তিনি আবার ট্রামেই যাতায়াত শুরু করেন। আজকালকার দিনে, কেউ ভাবতে পারবেন- এই কথা? অভিনয় করতেন কোনো মেকআপ ছাড়াই । সত্যজিৎ রায় একটি অমোঘ কথা বলেছিলেন তাঁর সম্বন্ধে- একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-” তাঁর অভিনয়ের কদর এই পোড়া দেশে কেউ করে না, তবে আমেরিকায় জন্মালে তিনি নিশ্চিত অস্কার পেতেন” যদিও পরশ পাথরের জন্য সত্যজিৎ রায় তাঁকে প্রতিদিন একশো টাকা পারিশ্রমিক এর প্রস্তাব দিলে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন-” ওরে বাবা আমি এত টাকা পাওয়ার যোগ্য নই.. আর সিনেমা পাড়ায় যদি রটে যায়- আমি রোজ একশো টাকা নিচ্ছি আমি আর কাজ পাব না মানিকবাবু ”

তিনি বাংলার গর্ব কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী ।

প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে আজীবন লড়াই করলেও মুখের হাসি ছিল অনাবিল। অনুপকুমারকে ছেলে বলতেন তুলসী চক্রবর্তী। প্রবল শীতে একবার অনুপকুমার, তুলসী চক্রবর্তীকে একটি সোয়েটার কিনে দেওয়ায় অনুপকুমারকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন তুলসী চক্রবর্তী । অভাব থাকলেও অভিনয়ের জন্য নূন্যতম টাকা নিতেন তুলসী চক্রবর্তী। উত্তমকুমার থেকে সত্যজিৎ, সকলকেই টাকা হাতে দিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ‘অবাক পৃথিবী’-র সময় একবেলা কাজের জন্য তাঁকে দেওয়া হল তিনশো টাকা। তিনি কিছুতেই তা নেবেন না। কারন, তখন তাঁর রেট দিনে একশো পঁচিশ টাকা। দলের অনেকের জামা-জুতো ছিঁড়ে গেলে নিজের হাতে সেলাই করে দিতেন তুলসীবাবু। অবসর সময়ে পৌরোহিত্য করে সংসার চালাতেন।

৩ মার্চ, ১৮৯৯ সালে কৃষ্ণনগরের গোয়ারী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন তুলসীবাবু। রেলে চাকরিরত বাবার অকালমৃত্যুর পর মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এসে তাঁর প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা ভাল চাকরী জোগাড় করা ।

ভাল গান গাইতে পারতেন, বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গের গান। কাকার অর্কেষ্ট্রা পার্টির গ্রুপ ছিল। তুলসী চক্রবর্তীও সে দলে যোগ দিয়ে কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। পরে কাকা স্টার থিয়েটারে যোগ দিলে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চিৎপুরের এক মদের দোকানে বয়ের কাজ জোটালেন। কাকা খবর পেলে কাজ ছাড়তে হল। এরপর কাজ নিলেন ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানে বেশিদিন মন টিকল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা গেলেন। যে জাহাজে পালালেন সেটিতে বোসেস সার্কাস পার্টিও চলেছিল। সেখানেই চাকরি নিলেন। মাঝে মধ্যে শোয়ের ফাঁকে জোকারও সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্য-কৌতুকের প্রতি ঝোঁকেন।

তুলসী চক্রবর্তী সার্কাসে থেকে কিছু খেলা যেমন শিখলেন তেমনি শিখলেন উর্দু ও হিন্দী বলতে। সার্কাসে তিনি ছ’মাস মত ছিলেন। চলে আসার কারন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন- ‘শরীর থেকে জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ বেরোচ্ছে দেখে চলে এলুম।’ কাকা তখন তাঁকে ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা হ’ত। তা দেখে তার অভিনেতা হতে ইচ্ছে করল।
জ্যাঠামশায়কে অনেক অনুরোধ করায় তিনি স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে ঢোকালেন। সে সময় প্রেসে তার মাইনে ছিল ৩২ টাকা। স্টারে এলেন ৮ টাকার মাইনেতে!
তৎকালীন ষ্টার থিয়েটারের মালিক ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর। এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো- সব শিখেছিলেন। ১৯২০ সালে প্রথম ষ্টেজে অভিনয় করেন। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি ষ্টার থিয়েটারেই ছিলেন। পরে যোগ দেন, মনমোহন থিয়েটারে। ১৯৬০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪২টা নাটকে অভিনয় করেন। তুলসী চক্রবর্তীর সিনেমা শুরু ১৯৩২ সালে, নিউ থিয়েটারের ‘পুনর্জন্ম’ সিনেমায়। তাঁর শেষ সিনেমা মৃত্যুর আঠারো বছর পর মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে ‘আমি রতন’।

সারাজীবনে ৩১৬ টি বাংলা ও ২৩ টি মত হিন্দী সিনেমা করলেও দারিদ্র ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। ১১ ডিসেম্বর ১৯৬১ তে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই অভিনেতা। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। প্রচণ্ড দারিদ্রতা তো ছিলই, তার ওপরে নিজের বাড়িটা দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরহিতদের জন্য। স্ত্রী উষারাণী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। দারিদ্রের কারনে স্বামীর সবকটি মেডেল বিক্রি করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। মারা যাওয়ার পর সরকারের তরফ থেকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোরও কোনও বন্দোবস্ত ছিল না তখন। অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। তিনি আছেন বাঙালির অন্তরে, রয়েছেন, থাকবেনও।

About The Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *